adsterra

ইবনে আরাবী এর সংক্ষিপ্ত জীবনী





 ইবনে আরাবী: দিব্যজ্ঞান লাভ করা এক সুফি দার্শনিক।

ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুসলিম দার্শনিকের নাম বলতে বললে কার নাম আপনার মাথায় প্রথমেই চলে আসবে? নিশ্চয়ই ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন কিংবা আল ফারাবির কথা ভাবছেন। একটি নাম, যা হয়তো শতকরা ৯০ জনের মাথায়ই আসবে না, তা হচ্ছে আল আরাবী। কারণ ইতিহাস তার দার্শনিক পরিচয় নির্ণয় করতে ভুল করেছে, তাকে আখ্যায়িত করেছে কেবলই একজন সুফি হিসেবে। অথচ ধর্মকে বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা, কুরআনের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা, হাদীসের দার্শনিক ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র, অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করে গেছেন তিনি। অবশ্য এটা ঠিক যে, সুফিবাদ নিয়েই তিনি বেশি কাজ করেছেন। যে কারণে তাকে ‘আল শেইখ আল আকবার’ বা সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তাই বলে তার দার্শনিক পরিচয়টা একেবারে ঢেকে ফেলা অবিচারই বটে।

মুহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন মুহাম্মদ ইবনে আলি আল আরাবি আল তাই আল হাতিমি তার পুরো নাম! নিজের প্রতিটি লেখার শেষেই লেখক পরিচয়ে এ নামটিই লিখেছেন। সংক্ষেপে ইবনে আল আরাবি নামে পরিচিত হন তিনি। ইসলামিক স্পেনের মুরসিয়া শহরে, ১১৬৫ সালে এক ধনাঢ্য মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পরিবার ছিল কর্ডোবার সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর মধ্যে একটি। এর কারণ কেবল এই নয় যে তার বাবা আলি ইবনে আল আরাবী ছিলেন কর্ডোবার প্রধান বিচারপতি। বরং, তার পরিবারের ছিল গৌরবের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস, যার শুরু ইতিহাসখ্যাত হাতেম তাইয়ের সময় থেকে। হাতেম তাই এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নাম।








: আল আরাবীর যখন ৮ বছর, মুরসিয়া তখন পার্শ্ববর্তী এক রাজার আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি সপরিবারে চলে যান লিসবন শহরে। কিন্তু সেখানেও সবকিছু ঠিকঠাক বনিবনা না হওয়ায় সিভিল শহর হয় তার পরবর্তী ঠিকানা। এ শহরেই তিনি শিক্ষা দীক্ষায় পূর্ণতা লাভ করেন, তার ধ্যান-জ্ঞান বিকশিত হয়। সিভিল শহর ছিল মধ্যযুগের সুফিবাদ চর্চার কেন্দ্রস্বরূপ। এ শহরেই অনেক বিখ্যাত সুফির সাক্ষাৎ লাভ করেন আল আরাবী, সংস্পর্শে আসেন অনেক বিদুষী নারীর, যাদের প্রভাব তার পরবর্তী জীবনে গভীরভাবে লক্ষণীয়। এর মধ্যে যে নামটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে মার্চেন এর ইয়াসমিন। ইয়াসমিনের গুণমুগ্ধ আরাবীর মুখেই শোনা যাক তিনি কী ধারণা পোষণ করতেন এই নারীর ব্যাপারে।

“তার কাজকর্মে এবং যোগাযোগে বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি তাকে নিয়ে গেছে শ্রেষ্ঠদের কাতারে!”- ইয়াসমিন সম্পর্কে আল আরাবী।




আবু জাফর নামক এক দরিদ্র কৃষক ছিলেন আল আরাবীর জীবনের প্রথম শিক্ষক, যিনি ঠিকমতো গুণতে জানতেন না, লিখতে পারতেন না! এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবিবর্জিত শিক্ষকের নিকটি প্রাথমিকভাবে কুরআন পড়তে শেখেন তিনি। এরপর একে একে সিভিলের সব বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে আরবি ব্যাকরণ, কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিসের ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র এবং ফিকহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। কৈশোরের পদার্পণ করেই আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। সমকালীন বিখ্যাত সুফিদের সাথে তার ভাব জমে ওঠে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ ছিলেন আরাবীর বাবার বন্ধু। সে সুবাদের রুশদের সংস্পর্শেও আসেন তিনি। ২০ বছর বয়সে আনুষ্ঠানিকভাবে সুফিবাদকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন তিনি।

ইবনে আরাবীর নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি দৈববাণী পেয়ে সুফিবাদের দিকে ধাবিত হয়েছেন। ঘটনাটা ১১৮৪ খ্রিস্টাব্দের। সিভিলের কোনো এক সরকারি অনুষ্ঠানে শহরের সকল গণ্যমান্যদের সাথে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ইবনে আরাবীও। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে যখন মদ্যপান শুরু হয়, তখন আরাবীও সকলের সাথে তাল মেলাতে মদের গ্লাস হাতে নেন। কিন্তু গ্লাসে চুমুক দিতে উদ্যত হলেই তিনি শুনতে পান কোনো এক অদৃশ্য স্বর! “হে মুহাম্মদ, তোমাকে কী এজন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে?”

“আমার একাকীত্ব যাপন শুরু হয় ফজরের সময়, যখন সূর্যকিরণ ধীরে ধীরে সব অন্ধকার দূর করে দিতে থাকে। তখন ‘গায়েবি’ (অদেখা/অদৃশ্য) জগতের রহস্যগুলো আমার কাছে একে একে জট খুলতে থাকে। ১৪ মাস আমি নির্জনে ধ্যান করেছি, সেগুলো দেখেছি আর লিখে রেখেছি।” – ইবনে আরাবী

তিনি মদের গ্লাসে চুমুক না দিয়ে সেটি রেখে দিলেন এবং দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করলেন। তার মন বিষণ্ণতায় ভরে উঠলো। খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তিনি দেখা পেলেন এক মেষপালকের। মেষপালকের সাথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি শহরের বাইরে চলে এলেন। কোনো এক নির্জন স্থানে এসে মেষপালককে অনুরোধ করলেন পোশাক বদলের জন্য। অতঃপর মেষপালকের ময়লা ছেঁড়া জামা গায়ে জড়িয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে একটি গুহায় প্রবেশ করলেন এবং সেখানে ধ্যানমগ্ন হয়ে ‘জিকরুল্লাহ’ বা আল্লাহর জিক্‌র শুরু করেন। তার এই ধ্যান ভাঙে ৪ দিন পর! সেদিন গুহা থেকে বের হয়ে তিনি বুঝতে পারেন নিজের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন চলে এসেছে। তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করেছেন!

এই ঘটনার পর আল আরাবীর জীবনধারা চিরতরে পাল্টে যায়। তিনি প্রায় ১৪ মাস একটানা নিভৃতচারীর মতো জীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি কেবলই একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করতেন, কথাবার্তা বলতেন। তিনি হচ্ছেন তার দীক্ষা গুরু শেখ ইউসুফ বিন ইউখালফ আল কুমি। টানা ১৪ মাসের নিভৃতযাপন শেষে তিনি নিজ বাসস্থানে ফিরে গেলেও সরকারি কাজে আর যোগ দেননি। যাবতীয় অর্থ সম্পদের মোহ ত্যাগ করে তিনি কেবল জিক্‌র আজগারে সময় ব্যয় করতেন।
[

দ্রুতই ইবনে আরাবীর আধ্যাত্মিক গুণের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো পুরো আন্দালুসিয়ায়। তার বাবার বন্ধু ইবনে রুশদও তার ব্যাপারে অবগত হন এবং তার সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ সাক্ষাৎ দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমত, রুশদের সাথে আরাবীর শৈশবে সাক্ষাৎ হয়েছিল, বয়সকালে আর হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, দুজন দুই মেরুর শ্রেষ্ঠ মানুষের সাক্ষাৎ ছিল এটি। রুশদ ছিলেন একজন আপাদমস্তক যুক্তিবাদী মানুষ, যিনি সকল প্রকার জ্ঞানকে যুক্তির ছাঁচে ফেলে ঝালিয়ে নিতেন। আর আরাবী ছিলেন এখন দৃষ্টবাদী মানুষ, যিনি আধ্যাত্মিকতার পূজারী ছিলেন।

সাক্ষাৎ দুজনের জন্যই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইবনে রুশদ এই সাক্ষাতে আধ্যাত্মিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন, দিব্যজ্ঞানের আগমন সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। তাছাড়া আরাবীর নিভৃতে জীবন যাপনের নানা দিক নিয়ে জানার কৌতুহল দেখান তিনি। আরাবীর সাথে এই সাক্ষাতের পরই আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পুনরায় চিন্তভাবনা শুরু করেছিলেন রুশদ। অন্যদিকে আরাবীও দর্শনের খুঁটিনাটি জানবার সুযোগ পান। যদিও আরাবী নিজেও একজন উৎকৃষ্ট দার্শনিক ছিলেন, তথাপি রুশদের প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। আধ্যাত্মিকতার মাঝে বিচরণ করেই কীভাবে দার্শনিকতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করা যায়, সে অনুপ্রেরণা তিনি রুশদের কাছেই পেয়েছিলেন।

: ইবনে আরাবী নিজের সকল কাজের তালিকা তৈরি করেছিলেন। তার সে তালিকা অনুযায়ী তার মোট লেখার সংখ্যা ২৫১টি, যেগুলোর মধ্যে কিছু অনুবাদকর্মও রয়েছে। যদিও ইতিহাসের বিভিন্ন উদ্ধৃতি অনুযায়ী তার মোট কাজের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে যায়। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ১৬টি বই অনুদিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায়। তবে, তার এত সংখ্যক লেখার কোনোটিইরই আদি কপি বা পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না।

এক্ষেত্রে আবার বিতর্কও রয়েছে। কিছু পাণ্ডুলিপিকে অনেকে তার সময়ের বলে উল্লেখ করলেও, অধিকাংশের ধারণা সেগুলো পরবর্তী সময়ের হাতে লেখা প্রতিলিপি মাত্র। যেগুলো আমরা পাই, সেগুলো হয় অনুবাদ কিংবা ছাপা প্রতিলিপি। কেবল তার প্রগাঢ় জ্ঞান আর গভীর সুফি চিন্তা ধারার জন্য তাকে সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলা হতো না, বরং সুফিবাদকে তাত্ত্বিক করে তোলার পেছনে তার অবদানের জন্যই তিনি এরূপ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করছি পাঠকের সুবিধার জন্য।

৪০ বছরের মধ্যেই জীবনের ভ্রমণ অংশটাও সম্পন্ন করেন ইবনে আরাবী। তিউনিস, ফেজ, মারাক্কেশ, বাগদাদ, সিরিয়া, কায়রো, আলেকজান্দ্রিয়া সহ তৎকালীন পৃথিবীর মোটামুটি সকল গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করে ফেলেন তিনি। এরপর তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে ভ্রমণ করেন হজ্বব্রত পালনের জন্য। কিন্তু কাবাশরীফ তাওয়াফ করাকালীন তিনি আবারো একটি দৈব আদেশ পান। তাকে মক্কায় কিছুকাল থাকার জন্য বলা হয়। আদেশ মেনে তিনি মক্কায় ৪ বছর অবস্থান করেন এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে ‘মিশকাত আল আনওয়ার’ বা হাদিস সমগ্র, ‘রুহু আল কুদুস’ বা আন্দালুসিয়ার সুফিদের জীবনী, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অন্যদিকে মক্কায় থাকাকালীনই ইবনে আরাবী তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’ রচনার কাজ শুরু করেন।

ক্রুসেডের সময় ইবনে আরাবী আনাতোলিয়ার (তুরস্ক) শাসক সুলতান কায় কাউসের নিকট চিঠি লিখে কঠোরহস্তে ক্রুসেডারদের দমনের অনুরোধ জানান। এর কিছুকাল পর তিনি নিজেই আনাতোলিয়া ভ্রমণ করেন কায় কাউসের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। সেখানে বেশ কয়েকবছর বসবাস করে দামস্কে স্থায়ী হবার পরিকল্পনা করেন। এখানে থাকাকালীনই বিগত ৩০ বছরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা করেন ‘ফুতুহাত আল মাক্কিয়াহ’। এখানেই ১২৪০ খ্রিস্টাব্দের ৪০ নভেম্বর পরলোকগমন করেন বিখ্যাত সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবী।

ইবনে আরাবীর কিছু দর্শন যতটা সহজ ছিল, কিছু দর্শন ছিল ঠিক ততটাই দুর্বোধ্য। দর্শন এবং সুফিবাদের ক্ষেত্রে তার ভাষারীতি এবং বর্ণনার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তার শব্দচয়ন এবং বুনন ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। তার লেখা পড়তে সুবিধা করার জন্য তার অনুসারীর কেবল তার লেখার জন্য পৃথক একটি অভিধান তৈরি করেছিলেন! পবিত্র কুরআনে যেরূপ মানবজাতির প্রতি সার্বিক বিধানসমূহ অত্যন্ত গম্ভীর এবং ঝংকারপূর্ণ কবিতার আকারে এসেছে, ইবনে আরাবীর কবিতাগুলো কিছুটা তেমনই। সমগ্র কুরআন একটি অতি উৎকৃষ্ট সাহিত্য। আর এই সাহিত্যকে আদর্শ ধরেই নিজে সাহিত্য রচনা করেছেন আরাবী।

ইবনে আরাবী শুধু সমকালীন সুফিদের শিক্ষক ছিলেন না, তিনি তার পরবর্তী সময়ের সকল সুফি সাধকের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণাদায়ী আদর্শ হয়ে আছেন। সুফিবাদ তার দ্বার যতটুকু প্রভাবিত হয়েছে তা অন্যান্যদের ক্ষেত্রে কল্পনার অতীত। কিন্তু তাই বলে তিনি একজন নিছক সুফি সাধক নন, তিনি একজন উৎকৃষ্ট দার্শনিকও বটে। ইসলামের গৌরবময় স্বর্ণযুগের মহান মনিষীদের দর্শন পড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তার দর্শন ছাড়া। শেষ করবো তার একটি উক্তি দিয়ে।

এককথায় ইউনিটি অব বিং এর মূলকথা হচ্ছে, “যেহেতু সৃষ্টিকর্তা সবকিছুর উর্ধ্বে এবং সর্বোৎকৃষ্ট, তাই তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে আলাদা নন কিংবা বিশ্বসংসার তার থেকে আলাদা নয়। বরং, সমগ্র মহাবিশ্ব তার মাঝেই নিমগ্ন আছে!” কিন্তু তার এই গভীর চিন্তা সমকালীন অনেকেই ধরতে পারেনি। ফলে তাকে ‘সর্বেশ্বরবাদী’ উপাধি দেয় অনেকে এই যুক্তিতে যে, তিনি সর্বত্র সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতি বিরাজমান বলেছেন হেতু তিনি সবকিছুকেই সৃষ্টিকর্তা বিবেচনা করেন! অথচ তার এই দর্শনে অত্যন্ত চমৎকারভাবে মানুষের জন্য পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার বাণী রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা যেমনি তার সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান, অন্য কথায় তার মাঝেই তার সৃষ্টি নিমজ্জিত হয়ে আছে, তেমনি একজন যথযথ পূর্ণাঙ্গ মানুষ তার কাজের মাঝেই বিরাজমান। অধ্যবসায় আর সাধনার মাধ্যমেই কেবল মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে পারে। আর যিনি পূর্ণতা লাভ করেন, তিনি সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারেন।

“অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতা সম্পর্কেও অজ্ঞ। কারণ সে তার অজ্ঞতায় প্রতিনিয়ত অবগাহন করে চলে! জ্ঞানী ব্যক্তিও তার জ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানী নয়। কারণ সে প্রতিনিয়ত তার জ্ঞানের আলোয় অবগাহন করে চলে! আর যে ব্যক্তি আল্লাহর একক অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে, একটি গাধাও তার চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখে বলে সে প্রমাণ করে!”

অন্যদিকে আল আরাবীর ফুতুহাত গ্রন্থটিকে এককথায় সুফিবাদের বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। সুফিবাদের তিনটি মূল স্তম্ভ যুক্তি, প্রথা এবং অন্তর্দৃষ্টিকে তিনি অনুপম দক্ষতায় ব্যাখ্যা করেছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থেই তিনি তার বিখ্যাত দর্শন ‘ওয়াহাদাত আল ওয়াজুদ’ বা ‘ইউনিটি অব বিং’ এর পরিচয় করান। এর সহজ বাংলা হতে পারে অস্তিত্ব বা সত্তার একত্ব। তার এই দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষকে তার অন্তর্নিহিত শক্তি আর সম্ভাবনার নাগাল পাইয়ে দেয়া। যিনি সঠিক পথে গিয়ে নিজের প্রকৃত ক্ষমতা উন্মোচন করতে পারবেন, তিনি ‘ইনসান আল কামিল’ বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবেন।

১৭ ই রমজান, শায়খুল আকবার মহিউদ্দিন ইবনে আরাবি (রহ) এর জন্মদিন।
🔯 ইবনে আরাবি (রহ) ছিলেন মহাবীর আরতুগুল গাজির পীর বা শায়েখ। 

সাদা-দাড়িওয়ালা'র অস্তিত্বের সন্ধানে পর্ব-২

 ১ম পর্বে আমরা গুপ্তসংঘের সাথে পরিচিত হয়েছি।এই পর্বে নির্মাতার সম্পর্কে জানবো,



তিনি কেমন মানুষ ছিলেন, কি উদ্দেশ্য নিয়ে পথ চলেছিলেন, কিভাবে কাজ করেছিলেন।
এই পর্বটি যথেষ্ট সেন্সিটিভ, গল্পের ছলে পড়ে নিলেই ভালো, অজান খবরে ঠাসা।আমি জ্ঞান পিপাসুদের মনের খোড়াক যোগাতে লিখতে বসেছি।১ম পর্ব পোস্ট করলে দলিল বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। অথচ সামান্য সন্ধানে খুজে পাওয়া সম্ভব ছিলো।অতপর কঠিনতম তুর্কিভাষার তথ্যসুত্র গুলো সংগ্রহ করেছি, সপ্তাহব্যাপী।আমার অবশ্য লাভ হয়েছে, জ্ঞানের পিপাসা অনেক খানি মিটেছে।২য় পর্বের বিলম্বতার এটাই কারন। যারা সোর্স খুজবেন নির্দিষ্ট টপিক উল্লেখ করবেন।
যারা নতুন পড়ছেন আগে ১ম পর্ব পড়ে নেন,
না হলে ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হবে
(ছবিগুলো গুরুত্বপুর্ন)।

* *



সাদা পাহাড়ের দেশ থেকে বাতাসে ভেসে শীত আসছে।দিগন্ত বিস্তৃত স্তেপ ভুমির পাহারের চুড়ায় বরফ জমতে শুরু করেছে, গাছপালা তেমন নেই গুল্ম আর ঘাসে ভরা, সমান্তরাল ভুমির কোথাও নদীর কাছে ঢালু, কোথায় মাঝে মাঝে টিলা।শীতের আমেজ প্রকট হচ্ছে, এখানকার শীত হীম-ভয়ংকার, গ্রীষ্মেই অনেক পাহাড়ের বরফ গলেনা।বসতি পরিবর্তনের এটাই সময়, যাযারব তুর্কিদের প্রতি বছরের নিয়ম। গ্রীষ্মে ককেশাশ , শীতে এরাল ভ্যালি। বসতির উপদেষ্টা ডুবন্ত সুর্যের দিকে তাকিয়ে গভির চিন্তায় মগ্ন আছে, কারন তারা এখন রাষ্ট্রহীন।তাদের পুর্বপুরুষরা নীল আকাশের নামে রাষ্ট্রের নাম রেখেছিলো "গোকতুর্ক"।পৃথিবীর এপাশ-ওপাশ করে গড়ে তোলা 'গোকতুর্ক' রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।পশ্চিমে ভলগা ও রোমান চাপ, পুর্বে চাইনিজ ও মঙ্গোল চাপ, দুই ধাপে রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে।"কায়ি"বসতি ও তাদের মিত্ররা এখন রাষ্ট্রহীন, ভাগ্যের উপর নির্ভির করে অটোকান পাহাড়ের নীচে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে।ওখানে শীত কম, নদী আছে, পশুগুলো ঘাস ও পানি পাবে।তুর্কিদের যাযাবর জীবনে পশুই একমাত্র বেচে থাকার অবলম্বন।পশু ভালো থাকলে বসতি ভালো থাকবে।



দেদে-করকুত কায়িদের উপদেষ্টা, উপায়ান্ত বের করাই তার কাজ, বসতির বে বসতি শাসন করে, আরো বে'রা আছে সাহায্যকারি। কিন্তু সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ নয়, বাস্তবায়ন করাও রক্ত-কঠিন কাজ।হিসাবে গড়মিল হলে ধ্বংস, অথবা অন্য গোত্রের দাসত্ব।এবারের বসতি স্থানান্তর দুঃশ্চিন্তায় ঘেরা, পুর্ব দিক থেকে মঙোল বা চীনারা আক্রমন করতে পারে।পশ্চিমে আছে জন্তুর মত লালচুলের সিথিয়ানরা,এরা চোরাগোপ্তা হামলা করে। স্থানান্তরের সময় হামলা করলে সকল পশু সম্পদ একসাথে পেয়ে যায়, শিশু ও নারীদের দাস বানাতে পারে।যতবেশি দাসী ততবেশি জনসংখা বাড়াতে পারবে, অন্যদের থেকে শক্তিশালী হবে অথবা বিক্রি করে দেবে।পাশেই রোমান সম্রাজ্য, অর্ধেক পৃথিবীর মালিক, ওদের দাসের বাজার চড়া।এসব কিছু বিবেচনা করতে, দেদে করকুত ধ্যনমগ্ন। একটা স্থায়ি সমাধান বের করা বড় জরুরি, সুর্য ডুবে যাচ্ছে।



কায়ি তুর্কিরা অঘুজ তুর্কির একটি শাখা। কায়িদের জাতিধারা হাজার বছরের পুরানো। তারা স্বাধিনচেতা, বীরবিক্রমে টিকে আছে স্তেপ ভুমিতে। কথনো ককেশাসে, কখনো আনাতোলিয়ায় কথনো ওটোকেনে, হাজার বছর ধরে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে, স্থায়ী ভুমি করতে পারেনি। স্থানিয় বাসিন্দারা সামানন্ত সমাজকেন্দ্রিক, এদের সাথেও বনিবনা হয়না। কায়িরা আকাশের একমাত্র মালিক টেঙ্গরিতে বিশ্বাসি, আর কোন দেবতা নাই। সামানদের অনেক দেবতা, তাদের সমাজও বৈষম্যমুলক।তুর্কিদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস রক্ষা করে যাযাবর থকতে হচ্ছে। আগে এমন ছিলোনা, তাদের পুর্বপুরুষ অঘুজ খান পৃথিবীর চার কোনাই শাসন করেছে। কোন জাতি দন্দ্ব ছিলোনা।কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে, কোন নিয়মনীতি নেই।জোর যার দখল তার, শক্তি যার বিচার তার।অঘুজদের ভবিষ্যত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ইনাল-সার-ইয়াভকুই হারানো রাজ্যের নবম শাসক, লজ্জার বেদনা নিয়ে উপদেষ্টা দেদে-করকুতের সাথে আলাপে বসেছে।তাদের কষ্ট ও দুশ্চিন্তা অনেক বিষয়ে। অন্য গোত্রগুলোর অবস্থা ভালোনা, ঘোড়া ও পশু চুরি নিয়ে ঝগড়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার, কৃষি জমি দখল নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। স্তেপে ভুমিতে ঘোড়া ও পশুই অবলম্বন। চলাফেরা, যুদ্ধ, শিকার ঘোড়ার উপর নির্ভরশীল , খাদ্য,পোষাক, সোনা পশুপালের উপর নির্ভরশীল। শক্তি ও নিরাপত্তা তলোয়ার, তীর, বর্শার উপর নির্ভরশীল। তাদের আছে শক্তিশালী রীতিনীতি ও সংস্কৃতি , নারী-পুরুষের সমান সম্মানের সমাজ, তাদের পুর্বপুরুষের বেধে দেয়া অলঙ্ঘনীয় অঘুজরীতি। পারিপার্শ্বিক চাপে তাও হুমকির সম্মুক্ষিন।



তারা নতুন কিছু সিদ্ধান্ত নিলো বাইরের দেশগুলো ঘুরে দেখবে। তারা কিভাবে সম্রাজ্য গড়লো, তাদের গোপন শক্তি কি? অঘুজ তুর্কিরা এতো শক্তিশালী ও সাহসি যোদ্ধা হয়েও রাষ্ট্রহীন।রোমানরা ও পারস্যরা হাজার বছর পাল্লাদিয়ে বিশ্ব শাসন করছে। শেষের বছরগুলোতে যুদ্ধের পরে যুদ্ধ করে গেছে দাগিস্তান ও আনাতোলিয়ায়। তদের সীমান্তবর্তী হওয়ায়, যুদ্ধের চাপ তাদের গোত্ররাষ্ট্রের উপর পড়ছিলো, তাতে তারা দুর্বল হয়ে যায়। পুর্বদিকের চাইনিজ গৃহযুদ্ধ শুরু হলে, অঘুজরা হয়ে যায় চিড়েচ্যাপ্টা। এবার অন্য রাষ্ট্র পর্যাবেক্ষন করার পালা।খবর যোগার করতে বিভিন্ন জায়গায় লোক পাঠালো।বসতি স্থানান্তর করেই বেড়িয়ে পড়বে "দেদে-করকুত"।



শীতের ব্যবস্থা শেষে, খবর পর্যাবেক্ষনে দেদে-করকুত। পারসিয়ানদের অবস্থা ভালোনা, সম্রাট খসরু খুন হয়েছে, উত্তরাধিকার নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেছে। এই অবস্থায় রোমানরা আনাতোলিয়া, দাগিস্থান দখল নিয়েছে। কাজার জাতি তাদের সখ্য হয়েছে। এদের সথে কায়িদের অনেকদিনের বিরোধ। তাদের পাশের সীমানা সিরিয়ায় চলছে আরব আতংক। আরব সম্পর্কে তেমন জানে না। এমন রাষ্ট্রের নামই শোনেনি। আরবরা নাকি বিনা রক্তপাতে গোত্র শাসন থেকে একটি রাষ্ট্র বানিয়েছে, তারপর আবার বিনা রক্তপাতে একটি রাজ্য জয় করেছে। অন্য রাজ্যের রাজাদের নিকট চিঠি পাঠিয়েছে, আনুগত্য করার জন্য, কেউ কেউ অনুগতও হয়েছে।তাতেই আশপাশের রাজা-বাদশাহের ঘুম হারাম। দেদে-করকুত বেশ আগ্রহ পেলো , কারন তাদেরও গোত্র শাসন ব্যবস্থা, তাদের পুর্বপুরুষ অঘুজ খানও সমস্ত রাজ্যে চিঠি পাঠিয়েছিলো। অনেক রাজ্য বিনা বাধায় জয় করেছিলো। আরো একটি বিষয় তার মনোযোগ কাড়ছে, আরবের সাফল্যের নায়ক , নিজেকে স্বর্গীয় দ্যুত (নবী) বলে পরিচয় দিয়েছেন।
তারাও একমাত্র স্বর্গীয় দেবতাকে মানে, তাদের পুর্বপুরুষে কেম ও বাকসি ( kam & baksi) নামে দুজন দ্যুত ছিলো , তারাই সমাজের সর্বোচ্চ সন্মানিত ব্যক্তি। সবার উপকার করেছিলেন, সবাই বিনাবাক্যে মানতো।পুর্বপুরুষের গল্পগুলির ধারক, বাহক দেদে-করকুত নিজেই।গোত্রপ্রধানদের সাথে সভা করলেন তিনি, সিদ্ধান্ত হলো দেদে-করকুত আরবিস্থান যাবে অঘুজদের সাফির হয়ে। প্রতিনিধিত্ব করবে আঘুজ তুর্কির ভবিষ্যতের।



সফর মাস ব্যাপি দীর্ঘ হলো। পারসিয়া, আনাতোলিয়া, রোম, সিরিয়া হয়ে আরবের মদীনায় (ইয়াসরিব) পৌছুলেন।তার অঘুজ প্রতিনিধিত্বের খবর প্রকাশ করলেন। সম্মানজনক আতিথেয়তা পেলেন। নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন। কয়েকজন সহযোগী (সাহাবি) এর সাথে আলাপ করলেন, জেনে নিলেন আরবের পুর্ব থেকে বর্তমান পর্যন্ত অন্ধকার ও আলোর ইতিহাস, কত কষ্ট আর ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারা। তাদের নেতার বিষয়ে জানলেন, তাঁর পুর্বপুরুষের কাহিনি জানলেন, এক শিশুর মরুভুমিতে নির্বাসন থেকে তাদের বংশের সুত্রপাত, নিজ গোত্রের শত্রুতায় দেশত্যাগ করেছিলেন জানলেন। মদীনায় এসে সকল গোত্রকে এক করে রাষ্ট্র বানালেন, কয়েক বছরের সংগ্রাম শেষে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন।
তাদের নেতা একজন নবী, তিনি যা বলেন তাই হয়। বিশ্বে বৈষম্য,অন্যায় নির্মুল করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তিঁনি এসেছেন। তাঁর স্বর্গীয় কিতাব আছে, সেখান থেকে বানী প্রচার করেন। মানুষ দলে দলে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছে। দেদে-করকুত আশার আলো দেখলেন, জাতি গঠনের মন্ত্রপেলেন।
এবার সাক্ষাতের মাহীন্দ্রক্ষন, দেদে-করকুত নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (দরদ) এর সাক্ষাতে বসলেন, নিজের কথা জানালেন, যা জানার জানলেন, তাকে স্বীকার্য দিয়ে বায়াত দিলেন, ফিরে আসার আগে , জিজ্ঞাস করলেন তারা কি কোনদিন তাদের এলাকায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? (বাইজান্টাইন যেহেতু বড় শত্রু)

জবাবে শুনলেন সুসংবাদ,
"নিশ্চয় একদিন কুস্তন্তুনিয়া বিজিত হবে। সেই বাহিনীর অধিনায়ক কতোইনা উত্তম এবং সেই বাহিনি কতোই না উৎকৃষ্ট বাহিনী।"

(মাসনাদে আহমাদ ৪/৩৩৫; ১৮৯৫৭)
(ফাতিহ ১৪৫৩ মুভিতে ৬২৭সাল উল্লিখিত)
ইতিহাস পরিবর্তনের সুসংবাদ নিয়ে, আলোকিত দেদে-করকুত ধন্যচিত্তে বসতিতে ফিরে এলেন।

বসতিতে ফিরে দেদে-করকুত গোত্রপ্রধানদের নিয়ে বসলেন,সব কিছু খুলে বললেন,সুসংবাদ জানালেন, ইসলাম ধর্মের কথা জানালেন, ৪জন কবুলও করলো।দেদে-করকুত নতুন পাওয়া জ্ঞান ও সাহসে সবকিছু বিচার বিবেচনা শুরু করে দিলেন, গোত্রে গোত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকলেন। দাড়ি বড় রাখলেন আরাবিদের মতো, সেই দাড়ি সাদা হলো মানুষ তাকে "আকসাকাল" বলে ডাকা শুরু করলো, সাদা-দাড়িওয়ালা। কয়েকদিনের মধ্যে প্রভাবশালী কুটনৈতিক হলেন, সব সমস্যার সমাধান দিতে থাকলেন।তার আরো একটি সম্মান যোগ হলো বাচ্চাদের নাম দিতেন।পরিবার প্রথা শক্তিশালী করলেন, ছেলে মেয়ে কারো অপছন্দে বিয়ে না। শিশুদের প্রতি নজর দিলেন, এদেরকে সঠিকভাবে গড়তে পারলে ভালো জাতী গঠন করা যাবে। প্রথমে তিনি বাচ্চাদের শিক্ষামুলক গল্প শুনাতেন। পরে আবিষ্কার করেন "কুপাজ" (kupaz) নামের দুই তারের এক বেহালা সাদৃশ্য বাদ্যযন্ত্র, কুপাজ বাজাতেন আর কাব্য গাইতেন। গানের মাধ্যমে তাদের পুর্বপুরুষের ঘটনাবহুল শিক্ষনিয় কাহিনি বর্ননা করেন, তাতে অঘুজ খানের বিশ্বজয়, বামসি বেইরেকের বিরহ, স্ত্রীর প্রেমে আজরাইলেন হার,নাম পাবার যোগ্যতা এগুলো ছিলো।প্রতিদিন বাচ্চারা ভিড়তো তিনি কুপাজ বাজিয়ে তাদের গান শোনাতেন, লোকে ওযান-আশিক বলতো, মানে গানের পাখি।এভাবে "ওযান" নামে এক পদের সুচনা হয়, সমাজের সন্মানিত ও আধ্যাতিকতার স্থান।তিনি মহাকাব্য রচনা করেন,১২টি মহাকাব্য ও কুপাজ বাজানোর কম্পোজিসন নিয়ে তার "কিতাবে দেদে করকুত"।



তার একটি শিক্ষামুলক কিতাবও হলো, জ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষায় ভরা, তা গানের সুরে মানুষের মুখে মুখে চর্চা হতে লাগলো।

রাজনীতিতে নতুন চাল খাটান, ৬৫৯ সালে ৯জাতি নিয়ে "কঙ্গার ইউনিয়ন" করেন।
সবাইকে আঘুজ খানের রীতিনীতিতে উজ্জীবিত করেন, মাতৃভুমির স্বপ্ন দেখান।
৬৮০ সালে "বরু বদুন" (Boru Budun) নামে একটি গুপ্তসংঘ গঠন হয়।
৫০জন চৌকস যোদ্ধার,এই সংঘের ৫টি বৈশিষ্ট্যঃ
১।স্বর্গীয় খোদার কাছে আত্মসমার্পন।
২।জাতি ও স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা।
৩।আনুষ্ঠানিক বিধিতে আনুগত্য।
৪।জ্ঞান ও শৃঙ্খলা।
৫।নিজস্ব সংস্কৃতি ও মুল্যবোধে বিশ্বায়ন।

তাদের খেতাব হয় "জাতির নেকড়ে"।
ওজিফা দেওয়া হয়, চায়না ও শত্রু রাষ্ট্রের খবর সংগ্রহ করা, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে তাদের শক্তি কমিয়ে দেওয়া, প্রতিহত করা।

দেদে করকুত বিভিন্ন জায়গা সফর করতেন,
কপুজ বাজাতেন আর নবী'র সাক্ষাতের কবিতা গাইতেন। মানুষ বিশ্বাস করতো তিনি ভিবিষ্যত বলতে পারেন।সব মানুষ তাকে বিশ্বাস করতো,
তার পরামর্শ নিতো, যেন তাদের "আলামিন"!!

তিনি আব্বাসি খিলাফাত যুগে বেচে ছিলেন।
তার ১০ম শাসক কায়ি ইনাল হান ও পরবর্তী ৩জন শাসকের প্রভাবশালী উপদেষ্টা থাকেন।
বলা হয় তিনি ৩০০ বছর বেচে ছিলেন, কোথাও ২৯৭ বছর।আবার বলা হয় নবী(দুরুদ) এর ওফাতের ১০০ বছর পরও বেচেছিলেন, ৩০০ বছর পর মারা যান। তিনি একবার ইসলামের দাওয়াত নিয়ে লেযগিইল প্যাগানিজদের কাছে যান,ওরা তাকে হত্যা করে। দাগিস্থানের আশে পাশে কোন গুহায় 'ইমাম করকুত' নামে কবর পাওয়া গিয়েছিলো, পরে রহস্যে হারিয়ে যায়।

তিনি তুর্কিদের আদর্শিক পুর্বপুরুষ, তাই নামের আগে 'দেদে' মানে দাদা বা নামের শেষে 'আতা' মানে পিতা সম্বোধন করা হয়।তাদের কিংবদন্তী পিতা, করকুত আতা বা দেদে করকুত (রাঃ)।

"কিতাবে-দেদে-করকুত" এর অনুবাদ কপি ১৮১৫ সালে জার্মানির রয়্যাল লাইব্রেরি অফ ড্রেসডেনে আবিষ্কারের পর বিশ্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হইচই পড়ে যায়।
মহাকবি দেদে-করকুত লিগেন্ডে পরিনত হয়,
বিশ্ব ইতিহাস পায় তার হারিয়ে যাওয়া কাহিনি,
মহাকাব্যটি ইউনেস্কোর বিভিন্ন লিস্টে জায়গা করে নেয়।

Kurulus Osman - Season 2

Image: Google কুরলুস উসমান ভলিউম-২৮ https://www.facebook.com/groups/1010099172743461/permalink/1108912709528773/ বিকল্প লিংক https://www.fac...